নরকঙ্কাল দিয়ে সাজানো হয়েছিল যে চার্চগুলো
কঙ্কাল দিয়ে বানানো ঝাড়বাতি দেখেছেন কখনো? মানুষের খুলি দিয়ে বানানো নান্দনিক স্থাপত্য কাঠামো কিংবা রক্ত-মাংসের মানুষের হাড়ের তৈরি জানালা, দরজা, পিলার চোখে পড়েছে কখনো? নিশ্চয়ই ভাবছেন কোনো হরর গল্প বা সিনেমার কথা লিখতে বসেছি। মোটেই না। এমনটা ঘটেছে এই বাস্তব জগতে। আপনার-আমার মতো সাধারণ মানুষের অস্থি দিয়ে ঘেরা এই স্থাপত্য কীর্তিগুলো কিন্তু কোনো সাধারণ ঘর-বাড়ি নয়, বরং ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতকে বিভিন্ন দেশের চার্চে মানুষের হাড়কে রীতিমতো ইন্টেরিয়র ডিজাইনিং এর একটি অংশে পরিণত করে ফেলা হয়। কী ছিল এর পিছনের গল্প? জানতে হলে ঘুরে আসতে হবে সেই সময়কার চার্চগুলো থেকে।
আওয়ার লেডি অফ দ্য কনসেপশন অফ দ্য ক্যাপুচিনস
রোমের ‘আওয়ার লেডি অফ দ্য কনসেপশন অফ দ্য ক্যাপুচিনস’ চার্চটি সাজানো হয়েছে প্রায় ৪০০০ খ্রিস্টান ভিক্ষুর হাড় দিয়ে, যারা ১৫০০ থেকে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। মারকিউস ডি সেডের বর্ণনা অনুযায়ী হাড়গুলো সাজানো হয়েছে ‘বারোক’ এবং ‘রোকোকো’ স্টাইলে যা সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের বিভিন্ন শিল্পকলায় প্রচলিত ছিল। তিনজন ভিক্ষুর কঙ্কাল এমনভাবে সাজানো হয়েছে যা দেখলে মনে হবে খোদ ম্যাকাব্রি (ভৌতিক একটি চরিত্র) চার্চে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে।
চার্চটি যে সময়ে তৈরি, তখন চারদিকে প্লেগের দৌরাত্ম্য চলছিল। এই মহামারীর প্রকোপে প্রাণ হারান লাখ লাখ মানুষ। গণকবর দিয়েও যখন সব মৃতদেহের সৎকার করা সম্ভব হচ্ছিল না। তখনই আওয়ার লেডি অফ দ্য কনসেপশন অফ দ্য ক্যাপুচিনসের মতো গির্জা নির্মাণ করে পুরনো অস্থিগুলোর একটি ব্যবস্থা করা হয়। পোপ অষ্টম আরবানের আমলে, ১৬২৬ সালে, রোমের এই চার্চটির নিচের সমাধিক্ষেত্র থেকে হাড় উত্তোলনের অনুমতি দেয়া হয়।
চার্চটির গায়ে মেমেন্টো হিসেবে তিনটি ভাষায় একটি বাণী লেখা রয়েছে যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘তোমরা এখন যা, আমরাও তাই ছিলাম। আমরা এখন যা, তোমরাও তাই হবে’। এই গভীর আধ্যাত্মিক বাণী নিয়ে এটি যুগে যুগে অজস্র পর্যটককে আকৃষ্ট করে চলেছে এক মায়ার টানে।
সেডলেক ওসুয়ারী
‘আওয়ার লেডি অফ দ্য কনসেপশন অফ দ্য ক্যাপুচিনস’ চার্চ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে চেক প্রজাতন্ত্র উপশহরে একটি চ্যাপেল নির্মাণ করা হয় যার নাম ‘সেডলেক ওসুয়ারী’। ‘ওসুয়ারী’ শব্দের অর্থ ‘অস্থির আধার’। নামকরণের সার্থকতা প্রমাণ করতেই যেন সুদৃশ্য ঝাড়বাতি, তোরণ আর পিরামিড আকৃতির ডিজাইনগুলো বানাতে মানুষের মাথার খুলিসহ সব মিলিয়ে প্রায় ৪০-৭০ হাজার হাড় ব্যবহার করা হয়েছে এখানে।
আর দশটি চার্চ থেকে আলাদা এই চার্চটির ইতিহাসও যে ব্যতিক্রমধর্মী হবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। পুরো ঘটনাটির সূত্রপাত ঘটে যখন হেনরি, চেক প্রজাতন্ত্রের সন্ন্যাসী দলের মঠাধ্যক্ষ, পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিনে প্রবেশ করেন তখন। জেরুজালেমের ‘হলি সেপালকার’ বা পবিত্র সমাধিক্ষেত্র, গোলগোথার যে জায়গাটিতে যিশু খ্রিস্টকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছে বলে মনে করা হয়, সেখানকার এক কৌটা মাটি সাথে করে নিয়ে আসেন তিনি।
চেক প্রজাতন্ত্রে ফিরে এসে সেডলেক সংলগ্ন একটি সমাধিক্ষেত্রের উপরে ঐ মাটি ছড়িয়ে দেন হেনরি। খুব দ্রুত গুজব রটে যায় এই পবিত্র মাটির স্পর্শ পেলে পুণ্য হবে। ক্রমে ক্রমে গোটা ইউরোপজুড়ে সেডলেক হয়ে ওঠে একটি কাঙ্ক্ষিত গোরস্থান। এর খুব অল্প দিনের মধ্যেই ইউরোপের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে প্লেগ। দ্রুতই অগণিত মৃতের সৎকার করা হয় সেডলেকে। কিন্তু তাও এত মানুষের স্থান সংকুলান করা কষ্টকর হয়ে উঠছিল কর্তৃপক্ষের জন্য। সবদিক ভেবে-চিন্তে তখন ওসুয়ারী নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। ওসুয়ারী নির্মাণের পুরো দায়িত্ব দেয়া হয় এক অর্ধ-অন্ধ সন্ন্যাসীর উপর যিনি কোনোমতে হাড়গুলো সাজিয়ে একটি কাঠামো দাঁড় করান। ৩০০ বছরের মধ্যে একটি শৈল্পিক কাঠামো নির্মাণ করা হয় যা আমরা এখনো দেখতে পাই।
১৮৭০ সালে ফ্রান্টিসেক রিন্ড নামের একজন কাঠ ভাস্কর চ্যাপেলের অভ্যন্তরীণ কাঠামোগুলো হাড় দিয়ে সাজানোর দায়িত্ব পান। তৎকালীন সময় প্রায় ৪০,০০০ হাড় দিয়ে পুরো কাজটি শেষ করেন তিনি। দিন দিন সংখ্যাটি বেড়েই চলেছে। আর তার সাথে সাথে চার্চটির নাম হয়ে গেছে ‘চার্চ অফ বোনস’ বা ‘অস্থির চার্চ’।
মনেস্ট্রি অফ সান ফ্রান্সিস্কো
পেরুর রাজধানী লিমার ‘মনেস্ট্রি অফ সান ফ্রান্সিস্কো’ ইউনেস্কো ঘোষিত একটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট বা বিশ্বের সেরা ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোর একটি। এটি নির্মিত হয়েছে লিমাবাসীদের অস্থি-কঙ্কাল দিয়ে। ভূগর্ভস্থ সমাধিক্ষেত্রটি চার্চের ঠিক নিচে অবস্থিত যা কয়েকটি গুপ্ত সুড়ঙ্গের সাহায্যে সোজা ট্রাইব্যুনালের বিচারকের চ্যাপেলে গিয়ে শেষ হয়েছে। মাটির নিচে স্কাল এবং ফিমার দিয়ে সাজানো বেশ বড় বৃত্তাকার ও অন্যান্য জ্যামিতিক নকশার নানা শিল্পকর্ম পাওয়া গেছে।
১৯৪৩ সালে মনেস্ট্রির নিচের মাটি খুঁড়ে হাজারো মাথার খুলি এবং হাড়গোড় উদ্ধার করা হয়। ধারণা করা হয় এই জায়গাটি ১৮০৮ সাল পর্যন্ত সমাধিক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হত। কেন্দ্রীয় গোরস্থানটি লিমার বাইরে অবস্থিত হওয়ায় এই সমাধিক্ষেত্রটির উপর চাপ খুব বেশি পড়ত। প্রায় ২৫ হাজার মৃতদেহ এখানে সমাহিত করা হয়েছে বলে জানা যায়। সমাধিক্ষেত্রটি ইট এবং মর্টারের তৈরি বলে তা এতোই শক্ত যে ভূমিকম্পও তাকে এক চুল নড়াতে পারেনি।
সান বার্নারদিনো আল ওসা
বাইরে থেকে দেখলে দক্ষিণ ইটালির মিলান শহরের ‘সান বার্নারদিনো আল ওসা’ চার্চটিকে আর দশটি সাধারণ চার্চের চেয়ে আলাদা কিছু বলে মনে হবে না। তবে ভারী কাঠের তৈরি ডাবল ডোরের গেটটি খুললেই চ্যাপেলের পাশের সুসজ্জিত ওসুয়ারীর দিকে চোখ আটকে যাবে। ক্রুশবিদ্ধ আকৃতিতে সাজানো স্তূপীকৃত হাড়ের দেয়াল যে কারো নজর কাড়তে বাধ্য।
১২১০ সালে মিলানের একটি সমাধিক্ষেত্রে জায়গা ফুরিয়ে গিয়েছিল। একটি নতুন ঘর বানিয়ে সেখানে পুরনো হাড়গুলো সংরক্ষণ করা হয়। এবার ১২৬৯ সালে তার পাশে একটি চার্চ নির্মাণ করা হয়। ১৬৭৯ সালে চার্চটি সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়। সে বছর গিয়োভানি আন্দ্রে বিফিকে বলা হয় প্রায় ৪০০ বছর আগের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর চ্যাপেলটিকে একদম নতুন করে ঢেলে সাজাতে। তিনি তখন পুরনো হাড়গুলো নান্দনিক উপায়ে সাজিয়ে দর্শকদের কাছে উপস্থাপন করেন। ১৭১২ সালে আগের চার্চটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এবার আরেকটি বড় নতুন চার্চ সেখানে নির্মাণ করা হয় এবং সাধু বার্নারদিনোর স্মৃতির উদ্দেশ্যে তা উৎসর্গ করা হয়।
চারম্না চ্যাপেল
পোল্যান্ডের ‘থার্টি ইয়ার্স’ এবং ‘সিলেসিয়ান’ এই দুটি যুদ্ধে নিহত ব্যক্তিদের মৃতদেহের সৎকার এবং অস্থি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে চারম্না চ্যাপেল। ১১৭৬ সালে স্থানীয় একজন ধর্মযাজক ভাক্লাও তোমাশেফ এই চার্চের দেয়ালগুলো তৈরি করেন মানুষের হাড়গোড় দিয়ে। সিলিং জুড়ে মাথার খুলি দিয়ে ক্রসবোন প্যাটার্নের ডিজাইন করা হয়েছে। বিভিন্ন মহামারী যেমন প্লেগ, কলেরা, সিফিলস এমনকি দুর্ভিক্ষে যারা মারা গেছেন, তাদের অস্থিও চার্চ সুসজ্জার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে।
চ্যাপেলের নির্মাতাদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রেখে চার্চের কাঠামোতে তাদেরও ঠাই দেয়া হয়েছে। তাদের মাথার খুলিগুলো পাওয়া যাবে চার্চের কেন্দ্রে।
কাপেলা দুজ ওসুস
পর্তুগালের প্রাচীর ঘেরা মধ্যযুগীয় শহর এভোরায় অবস্থিত ‘কাপেলা দুজ ওসুস’ ষোড়শ শতকে নির্মিত একটি ফ্রান্সিসকান চ্যাপেল যার ইন্টেরিয়র ডিজাইন করা হয়েছে মানুষের মাথার খুলি এবং হাড় দিয়ে। অন্যান্য চার্চ অফ বোনস থেকে এটি একটু আলাদা। এখানে শুধু ডিজাইনের জন্যই মানুষের অস্থি ব্যবহৃত হয়নি, বরং মাথার খুলি দিয়ে গ্র্যাফিটি বা মোটিফ নির্মাণের মাধ্যমে বিভিন্ন বার্তা ছড়িয়ে দেয়ার একটি উদ্যোগও নেয়া হয়েছে।
কাপেলা দুজ ওসিস চ্যাপেলে ঢুকতে গেলে আপনাকে অভ্যর্থনা জানাবে চেইনে ঝোলা নিঃসঙ্গ দুটি মৃতদেহ। একটি মৃতদেহ পূর্ণবয়স্ক একজন পুরুষের এবং অপরটি একটি শিশুর। তাদের পাশের সিলিং থেকে ঝুলছে বাইবেলের ল্যাটিন সংস্করণের একটি বার্তা, ‘জন্মদিন মৃত্যুদিন অপেক্ষা উত্তম’।